আমার স্মৃতিপটে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস

অনেকদিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লিখবো ভাবছি। আর লেখা হয়ে উঠে না। লিখতে গেলে সব স্মৃতি মিলিয়ে এক হয়ে যায়। স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে আসে। পরক্ষনেই আবার পিছুটান চলে আসে। আর লেখা হয় না। আজ অনেকটা ইচ্ছার বিপরীতেই লেখা শুরু করলাম। আশা করি তা একদিন শেষও করতে পারবো। তবে কথা আছে যদি আপনারা উৎসাহ যোগান। আর ছোট ছোট অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলিকে পাশ কাটিয়ে আমাকে একটু দায়মুক্তি দেন।

মুল কথায় আসি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ৪ আর ৫ এর মাঝামাঝি হয়ত হবে। সেই বয়সে আমি মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে দেখেছি সেরকম করেই বলার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আশা করি আপনাদের তা ভাল লাগবে। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগের ঘটনাবলী, মুক্তিযুদ্ধের শুরু ও দেশ যেভাবে স্বাধীন হয়েছে সে গুলোই শিশু বয়সের মত করে স্মৃতিচারন করবো। যারা স্বাধীনতাযুদ্ধ দেখেনি এবং যারা দেখেছেন সকলের কাছেই আশা করি আমার শিশু বয়সের মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিচারন ভাল লাগবে।  তাহলে পাঠক আপনাদের ওপর ভরসা করে শুরু করলাম…………………

পাঠক বিরক্ত হবেন না প্রথমে আমার পরিচয়টা একটু দেই। আমি আসলে তেমন পরিচিতি পাওয়া কেউ না। নরসিংদীর রায়পুরা থানার অন্তর্গত আমিরগঞ্জ গ্রামে সাধারন এক মধ্যবৃত্ত পরিবারেই আমার জন্ম। আমার আব্বার নাম মরহুম মোঃ আকবর আলী খান। আমিরগঞ্জ খা বাড়ী বললে অনেকে হয়ত চিনতে পারেন। ঠিক বড় বাড়ীর(সদু বেপারীর বাড়ীর) পশ্চিম পাশেই আমাদের বাড়ী। এলাকায় আসা-যাওয়া কম বিধায় অনেকেই আমাকে চিনেন না। স্মৃতিতে স্থানগত কিছু ঘটনা আছে সে জন্য অবস্থান বলে নিলাম। আপনাদের আর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। আসুন তাহলে মুল আলোচনায় আসি।

* ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ হয়ত হবে। এখনকার মত তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। ঢাকার সাথে ট্রেনেই ছিল আমাদের রায়পুরা থানার ৯৫% মানুষের যোগাযোগ। মাঝ রাতে ট্রেন থামলো আমাদের বাড়ী বরাবর। সেই সময়ে ট্রেনে চেইন টানার ব্যবস্থা ছিল। আর এইটার অনেক অপপ্রয়োগ হত। আমারা ঘুমাচ্ছিলাম। মা ঘুম থেকে একটু নড়েচড়ে উঠলেন। আমারও ঘুম ভেঙ্গেছে। কারো আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। মিনিট কয়েক পরেই দরজায় টোকার শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দিলেন মা। ঘরে প্রবেশ করলেন আমার বড় ভাই শাহালম খান ওরফে ফরিদ খান। মার সাথে কথা বলছেন। অনেক লোক হয়েছে মিটিংয়ে, আরো কিছু আমার না বুঝা কথা। ঠিক তখনই আমি বুঝলাম আজ ঢাকাতে কিছু একটা হয়েছে। আর আমার ভাই ঢাকা থেকেই মাঝ রাতে ট্রেনে করে বাড়ী ফিরেছেন। ভাই তখন এইট কি নাইনের ছাত্র। ছাত্রলীগ করতেন সে বয়সেই। পরে জানলাম, বুঝলাম এবং শুনলাম ঐদিনই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ছিল। শেখ মুজিবর রহমান কিছু গুরুত্বপূর্ন কথা বলেছেন কিংবা ভাষন দিয়েছেন। কি রকম যেন একটু শিহরন অনুভব করলাম। মনে হচ্ছিল গুরুত্বপূর্ন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সাথেই থাকুন, চলবে………

শেখ মজিবের ভাষন, স্বাধীনতা ঘোষনা, পূর্ব পাকিস্তান কিংবা পশ্চিম পাকিস্তান আর পাকিস্তান এই সব
রাজনৈতিক শব্দগুলি আমার জানার কথা না। এবয়সে তা বুঝারও কথা না। একটু পরেই ঘুমিয়ে পরলাম। সকাল বেলা যথারীতি ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মত ঘাস আর ঘাস ফরিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। বাড়ী থেকে মাত্র ১৫০ গজ দুরে রেল লাইন। কিছুক্ষন পর পর রেলগাড়ি আসা যাওয়া করে। রেলগাড়ির আসা যাওয়া কিংবা চড়ূই পাখির চাতুরতা দেখেই মুলত দিন কেটে যেত।
সকালেই দেখি বাড়ীর বড়রা কয়েকজন মিলে এখানে সেখানে কি যেন বলছে। এদের কথাবার্তা বুঝতে পারিনি, বুঝার চেষ্ঠাও করিনি। এসব আমার চিন্তার বাইরে। তবে এদের চোখে মুখে কি রকম যেন আতংকের ছাপ লক্ষ করলাম। কি যেন স্বাধীনতা না অনুমান এরকম কিছু বলাবলি করছিল। তবে আমি যতটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হল সামনে কোন বিপদ আছে। হা আমি ৮ই মার্চ, ১৯৭১ সালের কথা বলছি। সারাটা দিনই যেন কিরকম ঘোমট ঘোমট একটা ভাব ছিল।
৯ই মার্চ কিংবা ১০ই মার্চ, তার পরের দিনও হতে পারে। ভিতর বাড়ীতে খেলা করছিলাম। এমন সময় শুনি দূর থেকে ভেসে আসা শব্দ। কি বলছে ঠিক বুঝা যাচ্ছিল না। ভিতর বাড়ী থেকে বের হয়ে দেখি রেল লাইনে অনেক লোক। ছাড়া বাড়ীরদিকে নামছে। আর এই ছাড়াবাড়ী হলো বড়বাড়ীর আদি বাড়ী। বিশাল আকারের দালান বানানোর পর এই বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আর এই বাড়ীটিই তখন এমনকি এখনো ছাড়াবাড়ি হিসাবেই সকলে চিনে। তার খানিক পরেই আমাদের বাড়ী। লোকজন আমাদের বাড়ীরদিকে এগিয়ে আসছে। শ্লোগান দিচ্ছে, প্রত্যেকের হাতে বাশের মত কি যেন দেখা যাচ্ছে। মিছিলটি একেবারে আমাদের বাড়ীর কাছেই এসে পরেছে। এবার আরো জোড়েশুড়ে শ্লোগান দিচ্ছে। আমিও একটু এগিয়ে গেলাম। দেখলাম প্রত্যেকের হাতে বাশের লাঠি, হাতে বানানো তীর ধকুন। চিনতে পারলাম এরা করিমগঞ্জের লোক।
শিশু বয়সে প্রথম এত সুন্দর তীর ধনুক দেখলাম। শতাধিক লোক ত হবেই। সকলে এক সাথে শ্লোগান দিচ্ছে – তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। তীর ধনুক তৈরী কর, পাকিস্তানীদের খতম কর। বাশের লাঠি তৈরী কর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। আরও অনেক শ্লোগান। সবগুলি মনে রাখতে পারিনি। মিছিলটি আমাদের বাড়ীর উঠোন পেড়িয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে উত্তরদিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের বাড়ী ও গ্রাম থেকেও লোকজন এই মিছিলে যোগ দিচ্ছে। পিছু পিছু আমিও চললাম মিছিলের সাথে। নিজের অজান্তেই গ্রামের মাঝামাঝি চলে গেলাম। এর পর আর সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। মিছিলটি চলে গেল ঈদগা হয়ে বাজারেরদিকে আর আমি ফিরে আসছি বাড়ীরদিকে। অসমাপ্ত চলবে……

করিমগঞ্জের মানুষকে আমার চিনার কথা না। বয়সের দিক থেকে তখন আমি এই যোগ্যতা অর্জন করিনি। তবে মিছিলে অনেকের মাঝে আমি দুজনকে চিনতে পেরেছিলাম। এদের বয়স তখন ৮, ৯ কি ১০ হবে। উনারা দুভাই, বাবা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করতেন। কোন এক বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় করিমগঞ্জ প্রাইমারী স্কুলে দেখেছিলাম। আমার বড় বোনদের সাথে ঐ প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েছিলাম। উনাদের একজন হল আওলাদ হোসেন মৃদা আর অপর জন উনার বড় ভাই, নামটা মনে নাই।

সেই মিছিলে উনাদের দুই ভাইয়ের হাতে দুটি দৃষ্টি নন্দন তীর ছিল। এতকাল পরে আজও আমার চোখে তীর-ধনুক দুটি ভাসে। বাসের খাপ দিয়ে তৈরী ছিল। তীরের দুই মাথা বাকানো ছিল। আসলে ভাষায় তা বুঝাতে পারছি না। ঐ তীর দেখার পর থেকে আমি তা বানাবার চেষ্ঠা করতে লাগলাম। মনে হয় ওরকম করে বানাতে আর পারি নি। কিছুটা বুঝতে পারলাম নিরস্ত্র বাঙ্গালী এভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে । তীর-ধনুক আর বাশের লাঠি দিয়ে। বুঝতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধের মহড়া শুরু হয়ে গেছে। এর পর ২৫শে মার্চ,১৯৭১ পর্যন্ত আমার দৃশ্যপটে আর তেমন কিছু ধরা পরেনি। সাথেই থাকুন (এর পর শুরু হবে ২৫শে মার্চের কালো রাত), অসমাপ্ত …………………

২৫শে মার্চের রাত শেষে ২৬শে মার্চের সকালে পাখির কলকাকলীতে ঘুম ভাঙ্গলো, ঘুম থেকে উঠে সূর্যদয় দেখলাম। দেখতে পেলাম আমাদের বাড়ীর সামনে ও আশেপাশে কয়েকজন মিলে মিলে কি যেন বলাবলী করছে। ওদের অঙ্গভঙ্গি যেন কেমন লাগলো দূর থেকে। ওদের ভাবভঙ্গি একটু অন্যরকম মনে হলো আমার কাছে। কিছু একটা, সিরিয়াস কিছু একটা হয়েছে বলে আমি আমার মত করে অনুমান করলাম। আস্তে আস্তে এদের কাছে গিয়ে কিছু একটা বুঝার চেষ্ঠা করলাম। ওরা কি যেন স্বাধীনতা ঘোষনা, যুদ্ধ এসব কি যেন বলছিল। সামনে সমূহ বিপদের কথা বলছিল। বড়দের কথা বার্তা পুরাপুরি না বুঝলেও কিছু একটা বিপদ আচ করতে পেরেছিলাম।

আমাদের বাড়ীটা গ্রামের দক্ষিন মাথায়, খানিক পরেই রেল লাইন। হঠাৎ রেললাইনে চোখ যেতেই দেখলাম অনেক মানুষ রেল লাইন দিয়ে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছে। দেখলাম আমাদের বাড়ীর লোকজন রেললাইনের দিকে যাচ্ছে আর কি যেন বলাবলি করছে। বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। আমিও পিছে পিছে রেললাইনের দিকে ছুটলাম। তখন সকাল ৭টা হয়ত হবে। গ্রামে ত তখন টেলিভিশন ছিল না। টেলিফোন কিংবা আজকালের মত মোবাইলও ছিলনা। ফলে সকলেই আসলে কি হয়েছে তা বুঝতে পারছিল না। রেলের একেবারে কাছে যেতেই দেখি শত শত নারী পুরুষ অতি দ্রুত হেটে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে রেলপথ ধরে। ওদের চোখে মুখে আতঙ্ক, কি রকম ভীতসন্ত্রস্ত, যেন পিছন থেকে তাদের কেউ তাড়া করছে। অনেকের সাথে ছোট ছোট বাচ্চা রয়েছে, কারো কোলে বাচ্চা, আবার হাতে ধরে অন্য বাচ্চাকেও টানছে। সাথে থাকা পুরুষদের হাতে বেগ ও মাথায় বুঝা রয়েছে। আমাদের সাথে থাকা বড়রা ওদের কাছ থেকে জানতে পারলো ঢাকাতে পাকবাহিনী কামান আর মেশিনগান দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলছে।

পাকবাহিনী, পিলখানায় বিডিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। এই পথচারীরা নরসিংদী শহর থেকে নিরাপদ থাকার জন্য গ্রামের বাড়ীরদিকে অগ্রসর হচ্ছে। নরসিংদী শহরে টেলিফোন থাকাতে শহরবাসী রাতেই তাদের ঢাকায় থাকা আত্নীয় স্বজনের মাধ্যমে ঢাকায় পাকবাহিনী যে আক্রমন করেছে সেই খবর পেয়ে যায়। তারা জানায় শেখ মুজিবকে গ্রেপতার করে পাকিস্তান নিয়ে গেছে, কিংবা মেরে ফেলেছে। আর এরই মাঝে রেল লাইন ধরে আসা লোকজনের পরিমান বেড়ে যায়। খানিক পরেই দেখা গেল স্রোতের মত মানুষ আসছে, যেন মিছিল। অনেকে বলছিল পাকবাহিনী নাকি সড়কপথে তারাবর পর্যন্ত চলে এসেছে। হয়ত আর ঘন্টা খানেকের মধ্যই নরসিংদী শহরে এসে পড়বে। শত শত মানুষকে হত্যা করবে। এ আশংকায় শহর ছেড়ে তারা গ্রামের বাড়ীরদিকে রেললাইন ধরে ছুটছে।

অনেকে বলছিল, কামানের গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে কান পেতে তা শুনার চেষ্ঠা করলো। আমিও শুনার চেষ্ঠা করলাম এবং শুনলাম। আমাদের গ্রাম থেকে তারাবর কিংবা ভুলতা সোজাসুজি মাপলে হয়ত ২০ থেকে ২৫ মাইল হবে। আর সেখান থেকে কামানের গোলা ছুড়লে আমাদের অবস্থান থেকে শুনা যাওয়ারই কথা। অসমাপ্ত (চলবে, সাথেই থাকুন)…………….. ।

আজকের মত সে সময়ে রেল লাইনের পাশদিয়ে সড়ক যোগাযোগ ছিল না। সাজোয়া সামরিক যান নিয়ে পুরাতন ডেমরা ফেরি পাড় হয়ে নরসিংদীর দিকে আসার একমাত্র রাস্তা। এই রাস্তায় সে সময়ে ধীরগতির কাঠবডি বাস চলত। তা দিয়ে ঢাকা থেকে নরসিংদী আসা যাওয়া হতো। রেল লাইন ধরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলমান মানুষের মাঝে অনেকে বলছিল, নরসিংদী শহরেও নাকি কামানের গোলা এসে পড়ছে। খুবই ভয়ংকর কথা। চলমান পথচারীদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা না থেমেই কথা বলছে, যেন পাকবাহিনী তাদের ধাওয়া করছে।

এসব দেখতে দেখতে নাস্তার সময় পাড় হয়ে হয়ত সকাল ১০টা ভেজে গেছে। সে সময়ে গ্রামে ৮টার মধ্যই রাতের খাবার খাওয়া হত। আর তারপরই মানুষ ঘুমিয়ে যেত। কুপি, হারিকেন কিংবা তেলের সমস্যা তো লেগেই থাকতো। তাই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পরই ক্ষিধায় কাতর হয়ে যেতাম। আর আজ ১০টা বেজে গেছে। নাস্তা খাবার কথা ভুলেই গেছি। ক্ষনে ক্ষনে ভাবছি আমাদেরকেও গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ অন্য কোথাও চলে যেতে হয়ত হবে। রেলপথ ধরেই নরসিংদী হতে পাকবাহিনী পূর্বাঞ্চলে যাবে। রেলের পাশেই আমাদের বাড়ী। তাই আমাদের ঝুকিটা একটু বেশী। লক্ষ করলাম এদিন কোন ট্রেন আসা যাওয়া করছে না। ট্রেনের ড্রাইভাররা নাকি সব পালিয়েছে প্রান বাঁচাতে, এরকম কথা বার্তাই বড়দের কাছ থেকে শুনা যাচ্ছিল। যতই সময় পাড় হচ্ছে ততই যেন রেল লাইন ধরে মানুষের স্রোত বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে কামানের গোলার শব্দও শুনা যাচ্ছিল। আর মনে হচ্ছিল যেন পাকবাহিনী নরসিংদী শহরে এসেই পড়েছে। অসমাপ্ত (সাথেই থাকু্‌ন) চলবে ……………………

খানিক পরেই নাস্তা খেতে বাড়িতে আসলাম, নাস্তা খেলাম আর রেল লাইন দিয়ে আসা পথচারীরা কে কি বলছে তা বাড়ির মা-বোনদের বেশ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বলতে থাকলাম। আমাদেরকেও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে। ইতিমধ্যই এনিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গেছে। শুধু তা ই নয়, সব গোছগাছ করে রাখা হচ্চে যাতে করে যে কোন সময়ে দ্রুত সময়ে পালানো যায়। আমরা আট ভাইবোন, এর মধ্য চারজনের বয়সই ১০/১১ এর নীচে। আমাদেরকেও প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছে। আর সকলকে বাড়ির কাছাকাছি থাকতে বলা হচ্ছে। এদিকে রেল লাইনেরদিকে তাকিয়ে দেখি নিরাপদ স্থানে আশ্রয়মুখী মানুষের মিছিল বেড়েই চলেছে। অল্পসময়ের মধ্যই হয়ত পাকবাহিনী শহরে ঢুকে পড়বে। কামানের গোলার আওয়াজও আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে। এতে বুঝা গেল পাকহানাদার হয়ত আমাদের অবস্থান থেকে আর বেশী দূরে নাই।

অনেকটা শংস্কা নিয়েই আবার রেল লাইনে আসলাম। দেখলাম ক্ষুধার্থ নরনারী ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে হেটে চলেছে। যাদের সাথে বাচ্চার সংখ্যা বেশী ছিল তাদেরকে বেশী আতংস্কগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। অনেক বাচ্চা দ্রুত হাটতে পাড়ছিল না। তাই সাথে থাকা বড়রা তাড়া দিচ্ছে দ্রুত হাটার জন্য। অনেকের মাথায় ছিল টিনের ট্রাংক, কাধে ব্যগ ও কোলে শিশু। কি যে হৃদয় বিধারক দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার মত না। কৃষক-শ্রমিক আজ আর কাজে যাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা বাজারে যাচ্ছেন না। ছাত্ররা স্কুলে আর শহরে যারা মিলে চাকুরী করতেন তারাও আজ শহরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে্ন না। শহর থেকেই যেহেতু লোকজন পালিয়ে আসছে, তাই শহরে কারো যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আবার বাড়ি ফিরে আসলাম। আমার শিশু মনেও পালাবার একটা ছক আকতে থাকলাম। চিন্তা করতে থাকলাম পাকহানাদার যদি দ্রুত কাছাকাছি এসেই পড়ে আর দূর থেকে গুলি করে তাহলে কোন দিক দিয়ে গেলে পাকবাহিনীর নজরে পড়বো না এমন একটা পরিকল্পনা আটলাম। আমাদের মামার বাড়ি আদিয়াবাদে। তাই প্রাথমিকভাবেই সেখানেই যাওয়ার কথা বলছে বড়রা।

আজ আর খেলা ধূলায় মন নেই। প্রতিদিনের মত আজ আর কোকিল আর কোকিলের ডাক শুনার সময় নেই। আজকে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ, বাচবো না মরবো শুধু এসব নিয়েই চিন্তা করছি। শুধু একটাই কথা, একটাই চিন্তা পাক হানাদার বাহিনী আসছে। সামনে আমাদের অনেক বিপদ হবে। মেশিন গান দিয়ে গুলি করে এরা আমাদের মেরে ফেলবে। এসব নিয়েই ছোট বড় সবাই কথা বলছি। আর মোটা মোটা গাছ খোজছি। মেশিনগানের গুলির শব্দ পেলে মোটা একটা গাছের আড়ালে চলে যাবো। মোটা গাছ বিধায় গাছ ভেদ করে গুলি গায়ে লাগতে পারবে না। আবার বাড়ীর পাশেই পরিত্যক্ত পুকুরে তখন পানি ছিল না। দ্রুত পুকুরে নেমে বসলে আর গুলি গায়ে লাগবে না। দেখতে দেখতেই দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। বিকাল ৩টা কি ৪টা হবে। আবার রেল লাইনের দিকে ছুটলাম। রেলপথ দিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা আগের থেকে কয়েক গুন বেড়ে গেছে। আমাদের সাথে থাকা বড়রা পথচারীদের সাথে কথা বলছে। তারা বলছে সেই রাত কিংবা ভোর ৩টায় তারা ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে। রেলপথ ধরে হেটে হেটে আমাদের অবস্থান পর্যন্ত আসতে বিকাল ৩টা/৪টা বেজে গেছে। তারা সকলেই অতি ক্লান্ত শ্রান্ত। আর হাটতে পারছে না। ক্ষিদে আর পিপাসায় প্রান যায় যায় অবস্থা। সাথে থাকা বাচ্চাগুলির যে কি করুন অবস্থা তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। হৃদয়বিধারক দৃশ্য। অনেককে আমরা পানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারি নি। তবে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে আমরা কেউ কার্পূন্য করিনি।

এবার আমরা পেতে থাকলাম ঢাকার আসল খবর। ঢাকা থেকে আগতরা জানাচ্ছে, ঢাকাতে প্রচন্ড গোলাগুলি হচ্ছিল। কামান আর মেশিন গানের গুলি। বিকট শব্দ। যা ইতি পূর্বে আর কখনোই শুনেনি তারা। তাই তারা বুঝতে পেরেছিল ঢাকায় থাকলে প্রানে বাঁচা যাবে না। গুলি আর আতংস্ক এদেরকও তাড়া করেছে। কাল বিলম্ব না করে প্রান বাঁচাতে শহর থেকে পালিয়ে এসেছে। তারা অনুমান করছিল হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করছে পাক হানাদাররা। সকাল হলেই হানাদার বাহিনীর আক্রমনের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। এতো বিকল্প রাস্তা ছিল না। ঢাকা থেকে নরসিংদী যাওয়ার শুধু মাত্র দুটি রাস্তা ছিল। একটি হল রেল লাইন। অপরটি গুলিস্তান থেকে ডেমরা ফেরি ঘাট হয়ে নরসিংদী। এই রাস্তাটি পুরাপুরি পাকা ছিল না। রেল পথ আর সড়ক পথ দুটি ব্যবহার করেই ঢাকা থেকে নরসিংদীতে লোকজন পায়ে হেটে পৌছেছে। প্রায় ৪০ মাইল রাস্তা। ঘন্টায় ৪ মাইল বেগে হাটা যায়। এই গতিই একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের হাটার স্বাভাবিক গতি। এই হিসাবটা তখন জানতাম। যারা রাত ৩টায় ঢাকা থেকে বের হয়েছে তাদের প্রায় ১০/১২ ঘন্টা লেগেছে নরসিংদী বা আমাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌছতে। তাই অনুমান তিনটা চারটার দিকে ঢাকার লোকজন আমাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌছে গেছে। অনেকে এ ভাবে হেটেই রায়পুরা কিংবা ভৈরবে যাবে। আরো দূরের লোকজনও আছে। অনেকের বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এরা হয়ত আর বেশী দূর যেতে পারবে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে এরা হয়ত রাস্তার পাশে কারো বাড়িতে আশ্রয় নিবে।

এরই মাঝে অনেক কিছু দেখলাম, শুনলাম এবং বুঝলাম। মানুষ কেন ঢাকা থেকে পালিয়ে আসছে, কেন দীর্ঘপথ পায়ে হেটেই পাড়ি দিতেে হচ্ছে তা ইতিমধ্যেই বুঝে গেলাম। আমাদের যে কি অবস্থা হবে তা কিছুটা অনুমান করতে পারলাম। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রনে থাকতে চায় না। স্বাধীনভাবে এদেশের মানুষ বাচতে চায়। পশ্চিম পাকিস্তানের জুলুম/নির্যাতন আর মেনে নিবে না। তাই শেখ মজিবর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে। আর সে কারনেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙ্গালীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। জোড় করে তারা এদেশ শাসন করবে। এদেশের মানুষ তাদের দরকার নাই। দররকার এদেশের মাটি আর সম্পদ। আর এ কারনেই বাঙ্গালীরা পাকিস্তানের শাসনের বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছে। আর তারা পরাধীনতা মানবে না। এভাবেই ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালের দিনটি ভয়-ভীতি আর নানা জানা আর অজানা সংকায় কেটে গেল। কোথায় যাব, কোথায় পালাবো, কিভাবে পালাবো এসবই আমার একমাত্র চিন্তা।
আমার ঠিক মনে নেই ২৬শে মার্চেই আমরা পালিয়ে মামার বাড়ি আদিয়াবাদে গিয়েছিলাম কিনা। অনেক কিছুই আমার শিশু বয়সের স্মৃতি স্মৃতিপটে ধারন করতে পারি নি। আবার অনেক স্মৃতি ম্লান হয়ে গেছে। ওই সময়ের প্রতিটি দিনই অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিত। ঘন্টায় ঘন্টায় যুদ্ধের নতুন নতুন খবর মানুষের মুখে মুখে শুনা যেত। তারপর কতবার পালিয়েছি, কত স্থানে আশ্রয় নিয়েছি, কতবার দৌড় খেয়েছি তা হয়ত আজ ৪৬ বসর পরে সামান্যই মনে আছে। পাকিস্তানিরা ২৬শে মার্চেই নরসিংদী শহরে প্রবেশ করছিল কিনা তা আজ আর মনে নাই। খুব সম্ভবত ২৬শে মার্চের দিনই ঢাকার আশে পাশের জেলাগুলিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল। তখন অবশ্য নরসিংদী, নারায়নগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলা ছিল না। এগুলি ছিল মহকুমা বা সাবডিভিশন। আর আজকের নরসিংদী জেলা ছিল তৎকালীন নারায়নগঞ্জ মহকুমার আন্ডারে। এরশাদ আমলে নারায়নগঞ্জ মহকুমা ভেঙ্গে নরসিংদী মহকুমা হয়। আর আরো কিছুকাল পরে বৃহত্তম ঢাকা জেলার উল্লেখিত ৫টি মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়।
তারিখটি মনে নেই, যেদিন পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান নরসিংদী শহরে বোমা ফেলেছিল। ঠিক কয়টার সময় তাও আজ মনে নেই। আনুমানিক দুপুরের পর বিকট শব্দ করে কিছু জঙ্গি বিমান শহরের ওপর দিয়ে ওঠা নামা করছিল। এত প্রচন্ড শব্দ আর জীবনেও কখনো শুনিনি। ভয়ে আৎকে উঠলো প্রান। দেখতে দেখতে বিমানগুলি নরসিংদী শহরের দিক থেকে এসে আমাদের বাড়ির পশ্চিম মাঠ থেকে ঘুরে আবার শহরের ওপর দিয়ে ওঠা নামা করছিল। যখনই বিমানগুলি শহরের ওপর পৌছায় ঠিক তখনই প্রচন্ড শব্দ হত। তখন আমি সম্ভবত আমাদের বাড়িতেই ছিলাম। বিমানের শব্দ শুনেই আমাদের বাড়ি থেকে আরেকটু উত্তর পাশে আমার চাচার বাড়িতে দৌড়ে গেলাম। আমরা তখন ওই বাড়ির পশ্চিমে (আমার দাদার মূল বাড়ি) দৌড়ে গেলাম একটা গাব গাছের আড়ালে থেকে বিমানের আসা যাওয়া দেখতে থাকলাম সংকিত চিত্তে। আমরা ৫/৬ জন হয়তো হবো। সবাই ই আমার সম বয়সের কিংবা সামান্য অনুজ কিংবা অগ্রজ। সেখানে ওই সময়ে আমার চাচাত ভাইও ছিল আমাদের সাথে। তিনিই ছিলেন তখন বুজধার মানুষ। আমাদের এ সময়ের অবস্থান স্থলে একটি ডুবা পুকুর ছিল। পুকুরের পাশেই ছিল বাঁশ জাড়। বাঁশ জাড়ের গোড়ার নীচে আর পুকুরের পাড়ে একটি ছোট সুরঙ্গ ছিল। যখনই শহর থেকে বিমানগুলি ঘুরে আমাদের পশ্চিম মাঠের দিকে আসতো তখনই তিনি চিৎকার করে আমাদেরকে সুড়ঙ্গের ভিতরে চলে যেতে বলতেন। আমরাও ভয়ে সুড়ঙ্গের ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। জঙ্গি বিমান ঘুরে শহরের দিকে চলে গেলেই আবার সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে আসতাম। একটু এগিয়ে যেয়ে উকি মেরে বিমানের অবস্থান বুঝবার চেষ্টা করতাম। দেখতে পেলাম বিমানগুলি শহরের অনেক ওপরে ওঠে। তার পর সোজা খাড়াভাবে নীচেরদিকে নেমে আসে। মনে হচ্ছিল বিমানগুলি শহরে পড়ে যাচ্ছে। পর ক্ষনেই প্রচন্ড শব্দ- এটি বোমার আওয়াজ। সেকি আওয়াজ জীবনে এর পরে আর কোনদিন শুনিনি। বোমা ফেলে ঘুরে আবার আমাদের দিকেই আসছে আসছে। আবার যাচ্ছে শহরে, আবার বোমা ………। শহরের ওপরে ধূয়া আর আগুনের কুন্ডলী দেখতে পেলাম। জলছে শহর আগুন আর ধুয়া মিলে একাকার হয়ে গেছে শহরের আকাশ। ঠিক কতগুলি বোমা ফেলা হয়েছিল ঠিক মনে নেই। তবে ১০/১২টি হবেই। এগুলির ধ্বংশ ক্ষমতা ছিল অনেক বেশী। শহরের যেখানে বোমা ফেলা হচ্ছিল সেখান থেকে সোজা আমাদের বাড়ি ৩ কিলোমিটার হবে। পরে অবশ্য জানতে পারলাম শহরের কেন্দ্রস্থল বোমা মেরে ধ্বংশস্তুপে পরিনত করা হয়েছে। কিছুক্ষন পরেই দেখলাম রেল লাইন ধরে মানুষ নরসিংদী থেকে আসছে। জানলাম যে যেভাবে পেড়েছে শহর থেকে পালিয়েছে। কত মানুষ মারা গেছে তার কোন সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। বোমা হামলা শেষে জঙ্গি বিমানগুলি আবার ঢাকা ঘাটিতে ফিরে গিয়েছিল। যুদ্ধ কি জিনিস, যুদ্ধ বিমান কি জিনিস, বোমা কি জিনিস বুঝলাম। জীবনে প্রথম এমন ভয় পেয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল মরেই যাব, আমাদের বিমান থেকে দেখে ফেললে হয়ত আমাদের ওপরেই বোমা মারবে। যা হউক বেঁচে গেলাম, পাইলট আমাদেরকে দেখতে পাইনি। তাই বোমা থেকে বেঁচে গেলাম। ১০ মিনিটের মত বোমারু বিমানগুলি তান্ডব চালিয়েছিল।
এরই মাঝে মানুষের মুখে মুখে শুনলাম, আমাদের গ্রামও নাকি বোমা মেরে জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিতে পারে পাকিস্তানিরা। এমন আশঙ্কায় মন খারাপ হয়ে গেলে। ভয়ে গা শিউরে উঠলো। আমাদের কি হবে। পাকিস্তানিরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। আবার কেউ কেউ বলছিল, বোমা শেষ হয়ে গেছে। তাই বিমানগুলি ঢাকায় ফিরে গেছে। আবার বোমা বোঝাই করে ফিরে এসে আবার টান্ডব চালাবে। বড়দের ঝটলা দেখলেই পাশে যেয়ে শুনার চেষ্টা করি কি বলছে। কথাবার্তা শুনে যা অনুমান করলাম, তাতে আরো মহাবিপদ অত্যাসন্ন মনে হলো। অনেকক্ষন অপেক্ষা করলাম। মাঝে মাঝে আকাশে কান পেতে কিছু একটা আওয়াজ শুনতাম। মনে হতো বিমানগুলি মনে হয় আবার আসছে। এভাবেই দিনের বাকী সময় কেটে গেল। মনে হল রাতে আর বিমান আসার সম্ভাবনা নাই। কারন রাতে বিমান দেখতে পাবে না। তাই আসবে না। কিন্তু সকাল হলেই হয়ত আবার তান্ডব চালাবে।
 
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যই বিশেষ ব্যবস্থায় পাকবাহিনীর পাহাড়ায় আবার ট্রেন চলাচল শুরু হল। আর এই ট্রেনে করেই পাকবাহিনী টহল দিত। এরই মধ্য পাক হানাদার সারাদেশে ক্যাম্প স্থাপন করেছে। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর সাথে তুমুল লড়াইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে, আকাশবানী আগরতলা রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে। আমাদের পাশের বাড়িতেই ছিল তখন একটি রেডিও। ওনারা তাতী ছিলেন। তাতের কাপড় বুনতেন। তখন যারা তাতী ছিলেন তারাই এলায় তুলনামুলকভাবে একটু স্বচ্ছল ছিলেন। আর আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তখন কৃষি কাজের ওপর নির্ভর করতো। অর্থাৎ গ্রামের মানুষের জীবন জীবিকা চলতো কৃষি কাজের মাধ্যমে। এখনকার মত মানুষের এতো ইনকাম সোর্স ছিল না। আর গ্রামের কিছু লোক শহরে জুট মিলে চাকুরী করতো শ্রমিক হিসাবে। এদের অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল।
 
তবে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের অভাব অনটন তখন লেগেই থাকতো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই মানুষ অনেকাংশে কাজকাম ছেড়েই দিয়েছে। মৃত্যুর ভয় নিয়ে তো আর কাজ করা যায় না। ফলে ফসল ফলবে না। সামনে আরো কঠিন দিন আসবে। এসব আমিও বুঝতে পাড়ছিলাম। যাহউক পাশের বাড়ীতে যেয়ে তখন রেডিওতে খবর শুনতাম। সারাদেশের যুদ্ধের খবর তখন আগরতলা রেডিও স্টেশন থেকে পাঠ করা হতো। অসমাপ্ত, চলবে (সাথেই থাকুন) ……………

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *