ব্রেক্সিটে বড় ঝাঁকুনি বিশ্ব বাজারে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় ঐক্যের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়াটা গণভোটে নিশ্চিত হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থ বাজার বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাজ্যজুড়ে গণভোটের ফলাফলে ইইউ থেকে বিচ্ছেদের পক্ষ ৫২ শতাংশ ভোটে জয়ী হওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের নাটকীয় দরপতন হয়েছে।রয়টার্স বলেছে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের পর আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি দিল এই গণভোট। এটা এমন সময় ঘটলো যখন বিশ্বজুড়ে সুদের হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় নীতিনির্ধারকদের কপালে পড়েছে ভাঁজ।
পাউন্ডের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে একদিনে সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে এদিন।এক পর্যায়ে পাউন্ডের এর দর ১০ শতাংশ কমে ১ দশমিক ৩৩০৫ ডলারে নেমে আসে, যা ১৯৮৫ সালের পর সর্বোচ্চ দরপতন।স্টান্ডার্ড অ্যান্ড রেটিং-এর প্রধান রেটিং কর্মকর্তা ফিনান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, এর ফলে ব্রিটেনের পক্ষে এএএ রেটিং ধরে আর সম্ভব হবে না।
পুরো ইউরোপজুড়ে শেয়ারবাজারগুলো ব্যাপক দরপতন নিয়েই চালু হবে বলে ফিউচার্স ট্রেডিংয়ের পূর্বাভাস। ব্রিটেনের এফটিএসই ফিউচার্স ও জার্মানির ড্যাক্স ফিউচার্স প্রায় ৯ শতাংশ দর হারিয়েছে। ইউরো জোনের ইউরো স্টক্স ৫০ ফিউচার্সের দর ১১ শতাংশের বেশি পড়েছে।বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফলাফল ঘোষণার আগে ইইউতে থাকার পক্ষ জয়ী হবে বলে ব্যবসায়ীদের বাজির কারণে পাউন্ডের দর হঠাৎ বেড়ে দেড় ডলারে উঠে যায়।
কিন্তু পূর্ব-পশ্চিম ইংল্যান্ডে ভোটের প্রাথমিক ফলে ইইউ থেকে বিচ্ছেদের পক্ষে জয়ের জোরালো পূর্বাভাসে তা নেমে ১ দশমিক ৪৩ ডলারে ঠেকে। স্থানীয় সময় বিকাল ৩টা নাগাদ বিচ্ছেদ পক্ষ এগিয়ে থাকলে আরও দর হারায় পাউন্ড।
পাউন্ডের একদিনের এই সর্বোচ্চ দরপতনে লন্ডনের শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক এফটিএসই ১০০ দরপতন নিয়ে দিন শুরু করবে, যাতে ৭ শতাংশ কমে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে।পাউন্ডের দর কমায় বিদেশ থেকে আমদানিতে বেশি গুণতে হবে ব্রিটেনকে; অন্যদিকে পণ্যের দাম সস্তা হওয়ায় লাভবান হবে দেশটির রপ্তানিকারকরা।ইউরোর বিপরীতে পাউন্ডের দর প্রায় ৭ শতাংশ কমে ১ দশমিক ২০৮৫ ইউরোতে নেমেছে।
পাউন্ডের দরপতনের চাপে ইউরোর দরও ডলারের বিপরীতে কমেছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ইউরো চালুর পর একদিনে সর্বোচ্চ দরপতন।মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০০৮ সালের আর্থিক সঙ্কটের পর তারা এধরণে মারাত্মক পরিবর্তন আর দেখেননি।
লন্ডনের ইটিএক্স ক্যাপিটালের লেনদেন বিভাগের প্রধান জো রান্ডল বলেন, “এরকম আগে কখনো দেখিনি। এধরনের ঘটনা জীবনে একবারই ঘটে, যা লিম্যানস ও ব্ল্যাক ফ্রাইডের বড়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বড় দরপতন
* ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আন্তর্জাতিক সরাসরি ডলারের সোনায় রূপান্তরযোগ্যতা বাতিল ঘোষণা দেওয়ার পাউন্ডের ৩ দশমিক ৪ শতাংশ দরপতন হয়, যা ‘ নিক্সন শক’ নামে পরিচিত।
* ১৯৭৮ সালের ১ নভেম্বর পাউন্ডের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ দরপতন হলে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে, যেটা ‘অস্বস্তির শীত’ হিসেবে খ্যাত।
* ১৯৯২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে গেলে পাউন্ড ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ দর হারায়।
* ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি লিম্যান ব্রাদার্সের ধসের পর আর্থিক সঙ্কট যখন তুঙ্গে সেই সময় পাউন্ডের দর কমেছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যে ঐতিহাসিক এই গণভোটে ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট পড়েছে ৫২ শতাংশ, আর থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছেন সাড়ে ৪ কোটি ভোটারের ৪৮ শতাংশ।
৪১ বছর আগে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটিতে (ইইসি) যোগ দেওয়ার প্রশ্নে গণভোট দিয়েছিল যুক্তরাজ্যবাসী। তাতে ৬৭ শতাংশ ইইসির পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ওই ইইসিই পরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউতে রূপ নেয়, যার সদস্য সংখ্যা এখন যুক্তরাজ্যকে নিয়ে ২৮।
২৮ জাতির ইইউ জোটের সঙ্গে চার দশকের সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন পথে হাঁটার প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের এই গণভোটকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ‘ব্রেক্সিট’।
যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় জোট থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে কিছু ডানপন্থি রাজনীতিবিদের উদ্যোগে ১৯৯১ সালে গঠিত হয় ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি। দলটি ২০১৩ সালে স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে সাফল্য পায় এবং প্রতিনিধিত্বের বিচারে যুক্তরাজ্যের চতুর্থ শক্তিশালী দলে পরিণত হয়।
ইনডিপেনডেন্স পার্টির এই উত্থান কনজারভেটিভ পার্টির জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে অনেকটা চাপের মুখেই ইইউ প্রশ্নে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন কনজারভেটিভ নেতা ক্যামেরন, সেই ভোটের ফলই এখন তার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্যামেরন ইইউর পক্ষে অবস্থান জানালেও তার দলের একটি বড় অংশ বিপক্ষে অবস্থান নেয়।